একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে অবাঞ্ছিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদকে আগাছা বলা হয়। সাধারণত মানুষের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে যেমন খামার ক্ষেত্র, বাগান এবং পার্কে জন্মানো অযাচিত উদ্ভিদই হল আগাছা। শ্রেণীবিন্যাসগতভাবে, “আগাছা” শব্দটির কোন বোটানিক্যাল তাৎপর্য নেই, কারণ একই উদ্ভিদ যখন অযাচিতভাবে জন্মে তখন তাকে আগাছা বলা হয়; আবার যখন এটি যাচিতভাবে জন্মানো হয় তখন এটি মূল্যবান ফসল উদ্ভিদ হিসেবে বিবেচিত হয়। অনেক উদ্ভিদ যা মানুষ সাধারণভাবে আগাছা হিসেবে বিবেচনা করে, অনেক সময় তা জমিতে চাষাবাদ করা হয়। তাই, আগাছা শব্দটি যে কোন উদ্ভিদে প্রয়োগ করা যায় যদি তা মূল ফসলের মধ্যে আক্রমণাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায় বা পুনরুৎপাদন করে।
আগাছা নিয়ন্ত্রণ না করলে বাংলাদেশে গড় ৩৭.৩৩% ফসল নষ্ট হয়। খাদ্য শস্য ৩৩.১৬%, দানা শস্য ৪১.২৬%, ডাল জাতীয় শস্য ৩১.৮৮%, তেলবীজ ৪০.৮২%, আঁশজাতীয় ফসল ৩৪.২৩% এবং ধান ৪০.২৮% উৎপাদন আগাছার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
আগাছা কি?
আগাছা হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত, সমস্যা সৃষ্টিকারী বা অনিষ্টকারী উদ্ভিদ যা বপন বা লাগানো ছাড়াই অতিমাত্রায় নিজে থেকে জন্মে। আগাছা সাধারণত প্রতিযোগী, অদম্য স্বভাবের এবং অধিক বংশবিস্তারে সক্ষম। এদের জীবনচক্র স্বল্প মেয়াদের।
সহজ ভাষায়, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে অপ্রয়ােজনীয় উদ্ভিদকে আগাছা বলা হয়। অর্থাৎ আগাছা হল এক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদ যারা নানান ভাবে ফসলের ক্ষতি সাধন করে উৎপাদনশীলতা কমায়।
নির্দিষ্ট সময় ও ক্ষেত্রবিশেষে আগাছাকে সাধারণভাবে অবাঞ্চিত হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এগুলো ঔষধ, শাকসবজি, পশুখাদ্য ও জ্বালানি হিসেবে এবং জমির জৈব পদার্থ বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে আবাদকৃত জমির আগাছা হিসেবে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির উল্লেখ পাওয়া গেছে। একটি স্থানের আগাছা প্রজাতির সংখ্যা ঐ স্থানের ভূমি ব্যবহারের ধরন ও বাস্তসংস্থানিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে।
ধানের আগাছাঃ
ফসলের মধ্যে ধানে সবচেয়ে বেশি আগাছার আক্রমন হয়। তাই ধান ফসলে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে আগাছা দমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধানের সাধারণ কয়েকটি আগাছা হল- শ্যামা, ক্ষুদে শ্যামা, এরাইল, হলদে মুথা, বড় চেচড়া, ছোট চেচড়া, পানি ডগা, বড় চূচা, জৈনা, ঝিল মরিচ, শুশনি শাক, ইত্যাদি। শ্যামা ঘাসকে বৈশ্বিক ধানের ফলন কমের জন্য প্রধান আগাছা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আগাছা ধান ফসলের বৃদ্ধি রোধ করতে পারে, সংগৃহীত ফসল দূষিত করতে পারে এবং প্রায়ই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরা ধানের বিভিন্ন বালাই যেমন এফিড, ছত্রাক, রট এবং ভাইরাসের হোস্ট হিসেবে কাজ করে। ফলে ফসল উৎপাদনের খরচ বেড়ে যায় এবং ফলন অনেক কমে যায়।
আগাছার বৈশিষ্ট্যঃ
- আগাছা সরু বা প্রশস্ত পাতাবিশিষ্ট হয়।
- ঘাস জাতীয় আগাছা সাধারণত সরু পাতাবিশিষ্ট হয় যা একবীজপত্রীর অন্তর্ভুক্ত।
- প্রশস্ত পাতাবিশিষ্ট আগাছা অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ যা দ্বিবীজপত্রীভুক্ত।
- আগাছা আরোহী জলজ, স্থলজ এবং উভয় শ্রেণির হয়ে থাকে।
- প্রায় সকল আগাছা স্বভোজী তবে কিছু পরজীবী ও রয়েছে।
আগাছার প্রকারভেদ/ধরণঃ
আগাছা প্রজাতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ একবীজপত্রী উদ্ভিদ আর বাকি গুলো দ্বিবীজপত্রী। সাধারণ আগাছাসমূহ Poaceae, Cyperaceae, Leguminosae, Asteraceae, Euphorbiaceae, Scrophulariaceae, Amaranthaceae, Solanaceae ও Acanthaceae ইত্যাদি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। Eichornia, Potamogeton, Pistia ও Monochoria গণের প্রজাতিসমূহ জলজ পরিবেশের সাধারণ আগাছা। আগাছার কয়েকটি সাধারণ ধরণ নিম্নে দেয়া হল;
- সেজ – চেঁচড়া, হলদে মুথা, বড় চুচা, জয়না ইত্যাদি।
- ঘাস – দূর্বা, ক্ষুদে শ্যামা, বড় শ্যামা ইত্যাদি।
- চওড়া পাতা – শুষনি শাক, ঝিল মরিচ, চাঁদ মালা, পানি কচু, পানি লং, পানি ডগা ইত্যাদি।
আগাছা কিভাবে ক্ষতি করে? আগাছা দমন কেন প্রয়োজন?
একটি স্থানীয় বা অ-স্থানীয় উদ্ভিদকে বিভিন্ন কারণে আগাছা বিবেচনা করা হয় কারণ তারা ফসল উৎপাদন মারাত্বকভাবে ব্যাহত করে। ফসলের ফলন হ্রাস রোধ করতে আগাছা নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরী। আগাছাগুলো স্থানীয় উদ্ভিদের সাথে খাদ্য ও স্থানের জন্য প্রতিযোগিতা করে। কৃষি এবং পরিবেশগতভাবে আগাছা বিভিন্নভাবে ক্ষতি করে যা নিম্নে উল্লেখ করা হল:
- আগাছা মূল ফসলের সাথে সূর্যালোক, মাটির পুষ্টি, পানি এবং বৃদ্ধির জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে;
- আগাছা মূল ফসলের রোগজীবাণুগুলোর জন্য হোস্ট এবং ভেক্টর সরবরাহ করে এবং উদ্ভিদের গুণমানকে সংক্রমিত ও অবনতি করার বৃহত্তর সুযোগ দেয়;
- বীজ-ভক্ষণকারী পাখি এবং কীটপতঙ্গের জন্য খাদ্য বা আশ্রয় প্রদান করে;
- মানুষ এবং গৃহপালিত পশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর;
- ড্রেন, রাস্তার উপরিভাগ এবং অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের ক্ষতি করে।
আগাছা বীজের বিস্তারঃ
অনেক আগাছা তাদের প্রাকৃতিক ভৌগোলিক পরিসীমা থেকে মানব অভিবাসন এবং বাণিজ্যের সাথে মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। শস্য কাটার পরে আগাছা বীজ প্রায়ই ফসলের সাথে পরিবহন করা হয়, তাই মানুষ পরিবহনের বাহক এবং অনেক আগাছা মানুষের ক্রিয়াকলাপের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কিছু প্রজাতি সরকারী কর্তৃপক্ষের দ্বারা ক্ষতিকারক আগাছা হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে, যদি এগুলি নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তবে তারা দেশীয় ফসল উদ্ভিদের জন্য মারাত্বক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
কিছু আগাছা ঔষধ, শাকসবজি, পশুখাদ্য ও জ্বালানি হিসেবে এবং জমির জৈব পদার্থ বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হলেও অনেক আগাছা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ফসলের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত।